Wednesday, May 15বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

এক নজরে উন্নয়নে এরশাদ

বার্তা প্রতিনিধি: সাবেক রাষ্টপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় তাঁর নানার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস অবিভক্ত ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমা শহরে। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মকবুল হোসেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী। তাঁর পিতামহ মৌলভী শাহদৎ হোসেনও ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী এবং তিনিই ছিলেন কুচবিহার অঞ্চলের প্রথম মুসলিম আইনজীবী। পল্লীবন্ধু এরশাদের মাতার নাম মজিদা খাতুন। পিতা মকবুল হোসেন ছিলেন দিনহাটা মহাকুমার একজন দক্ষ আইনজীবী এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান এবং চার ভাই-এর মধ্যে প্রথম। তাঁর ডাকনাম ছিলো পেয়ারা। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দিনহাটায়। দিনহাটা হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

ছোটবেলা থেকেই পল্লীবন্ধু এরশাদ খেলাধুলার প্রতি ভীষণ অনুরক্ত ছিলেন। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি সব সময়ই থাকতেন প্রথম স্থানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন। সেনাবাহিনীতে চাকুরিকালে তিনি সেনা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চৌকস গল্ফ খেলোয়াড় এবং এদেশে তিনিই প্রথম গল্ফ খেলা জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করেছিলেন। এই খেলা বিস্তারে ও উন্নয়নে তাঁর ভুমিকা অপরিসীম। তিনি নিজে লন টেনিস খেলতেন। এ খেলাটির উন্নয়নেও তাঁর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা- ক্রীড়ার উন্নয়নে তাঁর একটি অনন্য কৃতিত্ব।

মেট্রিক পাশের পর দিনহাটা ছেড়ে পল্লীবন্ধু এরশাদ ১৮৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। এই কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ক্রীড়া এবং সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য সব সময়ই ছিলোÑ পাশাপাশি সাহিত্য কর্মেও ছিলো তাঁর একাগ্রতা। স্কুল জীবন থেকেই তিনি ছড়া ও কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশে তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ.-তে তার স্পেশাল বিষয় ছিলো বাংলা।

বি.এ. পাশের পর পল্লীবন্ধু এরশাদ তঁর পিতার একান্ত ইচ্ছায় এম.এ.-তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাস্টার্সে তাঁর সাবজেক্ট ছিলো- ইতিহাস। একই সাথে তিনি ল’-তেও ভর্তি হয়েছিলেন। উভয় বিষয়ে তিনি প্রিলিমিনারী পাশ করেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দেবার আগেই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার হিসেবে চাকুরী গ্রহণ করেন। ফলে তার আর এম.এ. এবং ল’ পাশ করা হয়নি।

১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাট সেনানিবাসে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে যোগদান করেন। ১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কমিশন লাভ করেন। ১৯৫৩ সালের ১ মার্চ তিনি কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পদাতিক বাহিনীর সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে থাকাকালে তিনি ১৪ পদাতিক ডিভিশন ফুটবল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ময়মনসিংহের স্বনামধন্য খানসাহেব উমেদ আলী সাহেবের কন্যা রওশন আরা ডেইজীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত হুসেইন মুহম্মদ ঢাকা আঞ্চলিক সেনা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চুয়াডাঙ্গা সেক্টরে তিনি মেজর পদে থেকে একটি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ডি.কিউ. ছিলেন। এরপর তিনি ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি রংপুরে ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তাঁকে করাচির মালি ক্যান্টনমেন্টে বদলী করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলেÑ সকল বাঙ্গালী সেনা-অফিসারদের সাথে তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েন এবং দেশ স্বাধীন হলে সকল বাঙ্গালী সেনা অফিসার ও জওয়ানদের সাথে তিনিও পাকিস্তানে বন্দী হন। তাঁকে রাখা হয় বেলুচিস্তানের লোরালাই প্রিজন ক্যাম্পে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে এই বন্দিশিবিরেরই থাকতে হয়। ১৯৭৩ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তখন তিনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। বাংলাদেশে ফিরে তিনি আবার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে এনডিসি কোর্স করার জন্য নয়াদিল্লি প্রেরণ করেন। ১৯৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৭৯ সালের ৭ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

এর মাঝে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তাঁর মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত ঘোষণা করে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সেনাপ্রধান হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৪ সালের ২৪ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। শাসনভার গ্রহণের পর তিনি দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের স্বার্থে ঐতিহাসিক ১৮ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করেন।

তাঁর ১৮ দফা কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো : ১. জনগণের অর্থনৈতিক মুক্ত অর্জনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুফল লাভ করা; ২. ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান হ্রাসের দ্বারা জাতীয় সম্পদের সুষম বন্টন; ৩. পল্লীমুখী উন্নয়ন; ৪. উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্প পণ্যের সুষ্ঠ বন্টন ও প্রতিযোগিতা; ৫. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন; ৬. কৃষকদের ন্যায্য অংশ প্রদান এবং তাদের জীবনধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভুমি সংস্কার; ৭. পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে পুঁজি গঠন ও সরবরাহ; ৮. বেসরকারি খাতের শিল্পকে উৎসাহ দান, বিনিয়োগ ও
বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি; ৯. সমবায় ও কুটির শিল্প; ১০. প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পুনর্গঠন, বিকেন্দ্রীকরণ ও কৃচ্ছতা সাধন; ১১. ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে উন্নতি সুনিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন; ১২. সম্ভাব্য সর্বাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি; ১৩. জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজে নারী সমাজের যোগ্য স্থান লাভে সাহায্য করা; ১৪. জনগণের জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা ; ১৫. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; ১৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ; ১৭. রাজনীতিতে কর্মের রাজনীতিতে রূপান্তর করা এবং ১৮. জাতীয় জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটানো এবং নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে সমুন্নত রাখা।

ক্ষমতা গ্রহণ এবং দেশ পরিচালনায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা তা যাচাই-এর জন্য ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ সারাদেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে এইচ.এম. এরশাদ ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ আস্থা ভোট লাভ করেন।

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি তিনি জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং তিনি এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে রাজনীতি এবং সাংগঠনিক যাত্রা শুরু করেন। রাজনৈতিক দল গঠনের পর তিনি দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে তারিখে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে তাঁর জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসন লাভ করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। তখন সংসদে প্রধান বিরোধী দলে থাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিশিক্ত হন।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৫ দিন পর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ জাতীয় সংসদে ভাষণ দিয়ে সামরিক আইন তুলে নেবার ঘোষণা দেন। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন “ এদেশে সামরিক আইন জারির পথ আমি চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিলাম। ভবিষ্যতে আর কোনো দিন বাংলাদেশে সামরিক আইন আসবেনা। আজ থেকে এদেশে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলোÑ যা কেউ কোনোদিন নস্যাৎ করতে পারবেনা।” সেই ঘোষণার দিনটিকে অর্থাৎ ১০ নভেম্বরকে জাতীয় পার্টি গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে দেশে স্মরণকালের সর্বাধিক উন্নয়ন সাধিত হয়। উন্নয়ন-সমৃদ্ধি-সংস্কার-কর্মসূচীতে তিনি দেশ পরিচালনার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। তাঁর দুটি কালজয়ী স্লোগান হচ্ছেÑ “৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলেÑ বাংলাদেশ বাঁচবে” এবং “মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান”। গ্রামের অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য তিনি ১৯৮৬ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার শেরে বাংলা নগরে বিশাল কৃষক সমাবেশে “পল্লীবন্ধু” উপাধীতে ভূষিত হন।

১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সার্কের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি জাতিসংঘ থেকে দুটি পুরস্কার লাভ করে বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতিসংঘের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পুরস্কার এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের পরিবেশ পুরস্কার লাভ করেন। দেশেও তিনি ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। পল্লীবন্ধু এরশাদ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশে টেনিস ফেডারেশনের চেয়ারম্যান, কুর্মীটোলা গল্ফ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এবং পথকলি ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর তিনি রংপুরে তাঁর মরহুমা মাতার নামে “মজিদা খাতুন মহিলা কলেজ” এবং মরহুম পিতার নামে রংপুরে “মকবুল হোসেন ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা করেন।

এক নাগাড়ে প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দেশে অসংখ্য উন্নয়ন, সংস্কারমূলক কর্মকান্ড সাধন করেন। তার মধ্যে যুগান্তকারী কর্মকান্ড হচ্ছে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা, ভুমি সংস্কার, ঔষুধ নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, পথকলি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠাতা, গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচী বাস্তবায়ন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, পল্লীতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া, গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটানো, শান্তি মিশনে সৈন্য প্রেরণ এবং সারাদেশে ৫০৮টি বড় ধরণের ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ ও ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন পাকা রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন সহ অগনিত উন্নয়ন ও কল্যাণকর কর্মকান্ডের শ্রষ্ঠা ছিলেন পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অন্ততঃ ৫০টি কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেছেন। উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সংস্কারের বরপুত্র এরশাদ এদেশে এমন কোনো সেক্টর নেইÑ যেখানে তিনি হাত দিতে পারেননি। দেশের গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লেগেছে তাঁর উন্নয়নের হাতের ছোঁয়া। তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্লীবন্ধু এরশাদ বিরোধী দলের দাবী মেনে নিয়েÑ সাংবিধানিক পন্থায় স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তখন প্রতিশ্রুত ছিলোÑ সব দলের মতো সমান সুযোগ দিয়ে তাঁর দলকেও নির্বাচন করতে দেয়া হবে। কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মাত্র ৬ দিন পর অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ১২ ডিসেম্বর স্ত্রী রশন এরশাদ, পুত্র শাদ এরশাদ ও কন্যা জেবিনসহ তাঁকে স্বপরিবারে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাঁর উপর এবং তাঁর পার্টির উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। সেসব কিছু উপেক্ষা করেও তিনি জাতীয় পার্টিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ অনুসারে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং তিনি নিজে ৫টি আসনে জেলে বসে নির্বাচনে প্রার্থী হন। সেই নির্বাচনে কোনো প্রচার ছাড়াই জেলে থেকে তিনি ৫টি আসনেই বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে দেশবাসী তথা গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তৎকালীন বিএনপি সরকার তাঁকে ৫ বছরের মেয়াদের মধ্যে একবারের জন্যেও সংসদে বসার সুযোগ দেয়নি। উপরন্তু বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা দায়ের করতে থাকে। সব মিলিয়ে বিএনপি সরকার পল্লীবন্ধু এরশাদের নামে ৪২টি মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে।

১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে জেলে থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনেও তিনি জেলে থেকে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এই নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে ২২ বছর পর তাদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর তিনি জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৮ সালে পল্লীবন্ধু এরশাদ তাঁর আর একটি যুগান্তকারী প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচী প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব দেশবাসীর কাছে পেশ করেন। মুক্তির তিন বছর যেতে না যেতেই রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়। পরবর্তীতে তিনি বিএনপি’র সাথে চারদলীয় জোটে যুক্ত হন। ফলে সরকার প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে জনতা টাওয়ার মামলাটি সচল করেন এবং এই মামলার রায়ে তাঁকে আবার জেলে যেতে হয়। ৪ মাস ১১দিন জেলে থাকার পর ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি মুক্তি লাভ করেন। তিনি কারাগারে গেলে ৪ দলীয় জোট প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাঁর মুক্তির আন্দোলন না করায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ৪ দলীয় জোট পরিত্যাগ করেন এবং তাঁর জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাজা ভোগ করার কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে পল্লীবন্ধু এরশাদ অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। ওই নির্বাচনের পর আত্মরক্ষার জন্য তিনি প্রায় ৬ মাস বিদেশে অবস্থান করতে বাধ্য হন।

দেশে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে পল্লীবন্ধু এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে যুগপতভাবে তিনিও সরকার বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন এবং ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সাথে তিনি তাঁর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করেন। মহাজোট গঠিত হবার পর দেশে সরকার বিরোধী আন্দোন তীব্র আকার ধারণ করলে “ ওয়ান ইলেভেন” খ্যাত অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে মাইনাস থ্রি ফরমুলায় পল্লীবন্ধু এরশাদকেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আবার তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ৩টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রত্যেকটিতে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকে রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একইভাবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অসুস্থ্যতার কারণে নির্বাচনী এলাকায় একবারের জন্যে না গিয়েও বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। এই নির্বাচনে তাঁর জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন লাভ করে সংসদের প্রধান বিরোধী দল হবার গৌরব অর্জন করে এবং পল্লীবন্ধু এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে অভিষিক্ত হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ তাঁর জীবনে একবার জাতীয় পর্যায়ে আস্থা ভোট, একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ৫ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।

পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। দেশের প্রভাবশালী প্রায় সব পত্রিকাতে তাঁর লেখা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত কাব্য, প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সব মিলিয়ে- মোট ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ “কনক প্রদীপ জ্বালো” “এক পৃথিবী আগামীকালের জন্য” “নির্বাচিত কবিতা” “নবান্নে সুখের ঘ্রাণ” “যুদ্ধ এবং অন্যান্য কবিতা” “আমাদের রক্তে ভেজা অ আ ক খ” “একুশের কবিতাগুচ্ছ” “অন্য দেশ অন্য মানুষ” “ইতিহাসে মাটির চেনা চিত্র” “যেখানে বর্ণমালা জ্বলে” “জীবন সন্ধ্যার সন্ধ্যাতারা” “কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলো” “ যে কবিতা সুর পেলো” “একুশের কবিতা” “ঈদের কবিতা” “জীবন যখন যেমন” “বৈশাখের কবিতা” “হে আমার দেশ” “প্রেমের কবিতা” “দেশ ও দশের কথা বলছি” “এক আকাশের সাত তারা” “যা ভেবেছি যা বলেছি” “সময়ের কথা ও আত্মবিশ্লেষণ” “আমার কর্ম আমার জীবন” এবং “বাংলাদেশঃ বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপরেখা”
আমার কর্ম আমার জীবন এটি পল্লীবন্ধু এরশাদের আত্মজীবনী গ্রন্থ। এটা তার আত্মজীবনীর প্রথম খন্ড। “আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়” নামে তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ডটিও লেখা শেষ করেছেন। তবে এটা এখনো প্রকাশিত হয়নি।

সবকিছু ছাপিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সকল মানবিক গুনাবলি সম্বলিত একজন নিখাদ ভদ্রলোক। তাঁর অমায়িক ব্যবহার দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ছিলেন একজন সংবেদনশীল মানুষ। কারো দুঃখ-কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা-ভালোবাসা, মানুষকে একান্ত আপন করে নেয়া ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুন। তিনি তাঁর কর্মে-কীর্তিতে বাংলাদেশের মানুষের মনে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছেন তা অমলিন থাকবে চিরকাল কপিঃ রিন্টু আনোয়ার

One Comment

  • […] বার্তা প্রতিনিধি: বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম জানাজা রোববার বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাসের সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা ও রংপুরে আরও তিন দফায় জানাজা শেষে… […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *