Monday, April 29বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ

বার্তা প্রতিনিধি: ঢাকার প্রগতি সরণিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ। পহেলা বৈশাখের আগেই দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি করা এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করতে চায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অভিযোগ আনা হবে তাদের বিরুদ্ধে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল সমকালকে নিশ্চিত করেছে এ তথ্য।

উপরোক্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (উত্তর বিভাগ) মশিউর রহমান জানান, সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করেই আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। পহেলা বৈশাখের আগেই চার্জশিট দাখিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ দুর্ঘটনায় কার কী দায় ছিল তদন্তে তা নিখুঁতভাবে উঠে আসছে।

মামলার বাদী নিহত আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, ‘যে কোনো বাবাই তার সন্তান হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইবেন। আমিও সেটা চাই। ঘাতক যাতে অপকর্মের প্রকৃত সাজা পায়, এটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।’

৩০৪ ধারায় বলা হয়েছে, সরাসরি খুন নয়; তবে যে ব্যক্তি তার কাজের মাধ্যমে অন্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে, মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে অথবা মৃত্যু ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে এমন গুরুতর আঘাত প্রদান করেছে- এ ধরনের কাজ সম্পাদন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার আবরারের মৃত্যুর দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ঘাতক সুপ্রভাত বাসের কনডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও হেলপার ইব্রাহিম। এর আগে এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম। একই মামলায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন কনডাক্টরকে আশ্রয়দাতা শামীম।

১৯ মার্চ রাজধানীর প্রগতি সরণির দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে প্রাণ যায় আবরার আহমেদ চৌধুরীর। ওই দুর্ঘটনার পর এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। ১১টি দাবির কথা জানিয়ে তা পূরণের জন্য আন্দোলনে নামেন তারা। এসব দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

৩০২ ধারার অধীনে চার্জশিট গঠন করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে দ্রুততম সময়ে অপরাধীর বিচার। সুপ্রভাত ও জাবালে নূর পরিবহনের সব বাসের রুট পারমিট বাতিল করা। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে আন্ডারপাস, ওভারব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা ও গেজেট আকারে প্রকাশ করা।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আবরারকে চাপা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কনডাক্টর ইয়াছিনের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। যদিও ঘটনার সময় বাসে চালকের আসনে ছিলেন তিনিই। ঘটনার দিন সুপ্রভাতের মূল চালক সিরাজুল ইসলাম শাহজাদপুর বাঁশতলা এলাকা পার হওয়ার সময় বাসটি মিরপুর আইডিয়াল গার্লস ল্যাবরেটরি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে চাপা দেয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।

ওই দুর্ঘটনার পর বাসের যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা তাৎক্ষণিকভাবে চালক সিরাজুল ইসলামকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেন। এরপর রাস্তার মাঝে বন্ধ হয়ে থাকা সুপ্রভাত পরিবহনের গাড়িটি চালান কনডাক্টর ইয়াছিন। বন্ধ হয়ে বাস যখন স্টার্ট নিচ্ছিল না, তখন সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আরেকটি বাস ডেকে এনে সুপ্রভাত গাড়ির পেছন থেকে ধাক্কা দিতে অনুরোধ করেন। কনডাক্টরকে বলা হয় সুপ্রভাতের গাড়িটি মূল রাস্তা থেকে সরিয়ে সড়কের পাশে নিতে। কিন্তু বাসের কনডাক্টর ও হেলপার ভেবেছিল বাসটি রাস্তার পাশে নিলেই পুলিশ জব্দ করবে। এ ছাড়া বাস মালিক ফোনে তাদের দ্রুত গাড়িটি দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরাতে নির্দেশ দেন। তাই কনডাক্টর ইয়াছিন গাড়িটি স্টার্ট নেওয়ার পরপরই রাস্তার পাশে না সরিয়ে দ্রুত গতিতে চালিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। পেছনে পেছনে পুলিশ কিছু দূর দৌড়ালেও আর গাড়ির নাগাল পায়নি তারা।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ জবানবন্দিতে ইয়াছিন স্বীকার করেছেন, বাস মালিকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই ক্ষিপ্ত জনতা ও পুলিশের কাছ থেকে রক্ষা পেতে তিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। কিছু দূর এসে প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে তার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এক ছাত্র। দুর্ঘটনার পরপরই যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে থেকে পালিয়ে গিয়ে ইয়াছিন চাঁদপুরের শাহরাস্তির একটি ইটভাটায় চাকরি নেন। ওই ইটভাটায় ইয়াছিনকে আশ্রয়দাতা শামীম তার পূর্বপরিচিত ছিল।

ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, যেহেতু একই দিনের সুপ্রভাতের একই বাস পরপর দুটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তাই পৃথক দুটি মামলা হবে। দুটি মামলায় পৃথকভাবে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী গুলশান থানায় যে মামলা করেছেন তার তদন্তভার ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথমে ওই মামলার চার্জশিট দাখিল করবে পুলিশ। এতে আসামি করা হচ্ছে ঘাতক বাসের কনডাক্টর ইয়াছিন, হেলপার ও বাস মালিক ননী গোপাল সরকারকে। এরপরই সুপ্রভাত পরিবহনের গাড়ির ধাক্কায় মিরপুর আইডিয়াল গার্লস ল্যাবরেটরি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে আহত করার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হবে। পরে ওই মামলায় আলাদা প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। এতে অভিযুক্ত হবেন বাসের মূল চালক সিরাজুল ইসলাম, হেলপার, কনডাক্টর ও মালিক।

পুলিশ এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা একাধিক সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করেছে। সেখানে দেখা যায়, দুটি জেব্রা ক্রসিংয়ের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে পার হচ্ছিলেন আবরার। সুপ্রভাত পরিবহনের বাস তাকে ধাক্কা দেওয়ার পরও বেপরোয়াভাবে চলতে থাকে। বাসটি তাকে হিঁচড়ে নিয়ে জেব্রা ক্রসিং পর্যন্ত চলে যায়। আশপাশের লোকজন প্রথমে দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখলেও কেউ এগিয়ে যায়নি। অন্য যানবাহনও দুর্ঘটনাস্থলে না থেমে আবরারকে ফেলে পার হয়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পর এক ব্যক্তি চিৎকার করে লোকজন জড়ো করেন। ততক্ষণে আবরারের রক্তে ভিজে গেছে পিচঢালা রাজপথ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবরারের মৃত্যুর পরপরই প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে দ বিধির ৩০৪ ধারায় মামলা হয়েছে। সেই মামলায় সুপ্রভারের বাসচালক, মালিক, হেলপার ও কনডাক্টরকে আসামি করা হয়। যদিও পরে তদন্তে উঠে এসেছে আবরারের মৃত্যুর সময় মূল চালক সিরাজুল বাসে ছিলেন না। ভুল তথ্যে দাখিল হওয়া এজাহারের ব্যাপারে তদন্ত-সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ফৌজদারি মামলার এজাহারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তদন্তের ভিত্তিতে কী তথ্য পাওয়া গেল? তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র তৈরি হয়। সেই আলোকে বিচার হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিকভাবে এজাহারের তথ্যের গরমিল থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা যদি আসামির দায় প্রমাণ করতে পারেন, সেটাই শেষ বিবেচ্য বিষয়।
সূত্র: সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *