Wednesday, May 8বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

সাবেক সফল রাষ্টপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার্তা প্রতিনিধি: বাংলাদেশের আপামর জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হইয়াছে, ইহা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’ এই ঘোষণা দিয়ে যিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করলেন তিনি লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে নিজেকে গদিনশিন করেন তিনি। এর আগে ছিলেন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল।

তারপর লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়ে উঠলেন ‘পল্লীবন্ধু’। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি দাবার একটি বিশেষ গুটি। তাঁর কথা ও কাজের অমিল, বারংবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবকেই প্রতীয়মান করেছে। সামরিক এই শাসককের জন্য দেশের মানুষ যেমন ঘৃণা পোষণ করেন, তেমনি এক কালের স্বৈরাচারী এই শাসকের কিছু উন্নয়নমূলক কাজে সাধারণ জনতা সরাসরি উপকৃত হওয়ার কথা স্মরণও করে।

লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত। স্বৈরাচার বিরোধী প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

এরশাদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলায়। কুচবিহার ও নিজ শহর রংপুরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন এরশাদ।

১৯৬০-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন। এরশাদ ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ।

পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। তিনি ১৯৭৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর সংবাদপত্রে বিবৃতি ও কভারেজের মাধ্যমে রাজনীতিতে এরশাদের আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন।

ক্ষমতা দখলের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করেন। জাতীয় সংসদ বাতিল করেন এবং সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন এরশাদ। যে সাংবিধানিক পদটি একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানেরই প্রাপ্য ছিল। তিনি ঘোষণা করেন যে ভবিষ্যতে সামরিক আইনের অধীনে জারিকৃত বিধিবিধান ও আদেশই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সকল আইন অকার্যকর হবে।

১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন এরশাদ। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব ছিল না, কারণ ঘোষিত সামরিক আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ছিল যে সিএমএলএর উপদেশ বা অনুমোদন ব্যতীত প্রেসিডেন্ট কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ বা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৮৪ সালে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় উপজেলা পদ্ধতির প্রচলন করেন এরশাদ। উপজেলা পরিষদসমূহের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের মে মাসে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদকালের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

মে-১৯৮৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বর্জন করে। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহবান করেন।

প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। প্রধান বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের তেসরা মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে। অবিরাম আন্দোলন এবং প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ক্ষমতার অপব্যবহার করলে একসময় তা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেই। এরশাদের জীবনে এলো এবার সেই পালা। ১৯৯১ সালেতিনি গ্রেপ্তার হলেন, পরাক্রমশালী এরশাদ হলেন কারাবন্দি।

তবে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায়ও এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে এবং কোনো কোনোটিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। এরমধ্যেই যেন ভয়াল এক ‘রাহু’ তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছে। রাজনৈতিক প্যাঁচে নিজেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন একসময়ের সামরিক শাসক এরশাদ। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখানো সেই এরশাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনতার আস্থাহীনতায় ক্রমেই যেন তলিয়ে যাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে ২০০০ সালে জাতীয় পার্টি তিনটি বিভক্ত হয়ে গেল উপদলে।

তবে ‘পল্লীবন্ধু’ এরশাদের শাসনকালীন বড় সাফল্য হচ্ছে থানা পর্যায়ে দেশব্যাপী উপজেলা স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার্যকরভাবে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রশাসন ও পরিকল্পনায় তাদের অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাই উপজেলাগুলোকে উন্নয়ন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উন্নীত করার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে একটি আইনি কাঠামো দাঁড় করাতে ১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০টি ধাপে ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

তাঁর শাসনকালে জেলা পরিষদসমূহ সক্রিয় ও কার্যকর করার জন্যও এরশাদকে সাধুবাদ দেওয়া হয়। এরশাদের আরেকটি বড় সাফল্য ছিল দক্ষিণ এশীয় সহযোগীতা সংস্থা (সার্ক) গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেওয়া।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং দেশে ব্যক্তিখাতের বিকাশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সরকারি মালিকানাধীন উত্তরা, পুবালী ও রূপালী ব্যাংকের বিরাষ্ট্রীয়করণ। এসময়ে দেশে প্রথমবারের মতো বেশ কয়েকটি বেসরকারি বাণ্যিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিকে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি প্রদান করা হয়। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও সংস্কারেও এরশাদ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার মাধ্যমে দেশে জেলার সংখ্যা ৬৪ করা হয়। এগুলোর অধীনে আবার ন্যস্ত করা হয় ৪৬০টি উপজেলাকে। কে

এরশাদ আমলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল পুলিশসহ বিভিন্ন সিভিল পদে মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ। তবে প্রশাসনের আকার কমাতে তিনি বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় দপ্তর বিলোপ করেন এবং অনেক দপ্তর একীভূত করেন। ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট বেঞ্চ বসিয়ে এরশাদ উচ্চতর আদালত বিকেন্দ্রীকরণেরও প্রয়াস চালান, কিন্তু বাংলাদেশ সyুপ্রম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ে পরে তা খারিজ হয়ে যায়।

এরশাদ সরকার দেশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমি সংস্কারেরও প্রয়াস চালান। ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে ১৯৮৭ সালের মার্চে একটি ক্যাম্পেইন হাতে নেওয়া হয়। এর লক্ষ্য ছিল: ভূমিহীন, প্রায়-ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ, অপারেশন ঠিকানা কর্মসূচির আওতায় সরকারি জমিতে ভূমিহীনদের জন্য গুচ্ছ-গ্রাম প্রতিষ্ঠা; বর্গাচাষীদের আইনগত অধিকার প্রদান; অধিকতর উৎপাদনের জন্য পাহাড়ি জমি, মৎস্য ও চিংড়ি চাষের জমির সর্বোত্তম ব্যবহার; পল্লী অঞ্চলের আয় বন্টনে অধিকতর সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উচ্চতর কৃষি উৎপাদনে অবদান রাখা; গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে অভিবাসন হ্রাসে সহায়তা করা। তবে তাঁর অন্য অনেক উদ্যোগের মতোই ভূমি সংস্কারের উদ্যোগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় মূলত আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে।

১৯৮২ সালে ঘোষিত নতুন শিল্পনীতিকে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য আরো উদার করে এরশাদ ১৯৮৬ সালে আরেকটি শিল্পনীতি ঘোষণা করেন। বিশেষত উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকার কারণে এরশাদের অনুসারীরা তাঁকে ‘পল্লীবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন।

প্রচারে মো: ওসমান গনী শাকিল, কেন্দীয় সদস্য, জাতীয় সেচ্চাচেবক পার্টি

সূত্র: মানবকণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *