Thursday, May 2বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

রাব্বির স্নপ্ন আর কখনো পূরন হবেনা

বার্তা প্রতিনিধি: হয়তো করো উপারর্জন করার ক্ষমতা ছিলনা। তাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে নিহত নারায়ণগঞ্জের ফজলে রাব্বি। ছোটখাটো একটি চাকরি করলেও পুরো সংসারটাই চলত তার উপার্জনে। তার টাকায় মাস্টার্স পাস করেছেন ছোটভাই রিফাত আলম। ছোট বোনটিকেও বিয়ে দিয়েছেন।

তিনি মূলত পরিবারের আয়ের মূল উৎস ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে পরিবারের সবার ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা সেই স্বপ্নকে ছাই করে দিয়েছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে অমাবশ্যার ঘোর অন্ধকার। শুধু রাব্বি নয়, তার মতো আরো ২৪টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে আগুনে। নিভে গেছে তাদের পরিবারের স্বপ্নও। লাশ গতকাল স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

নিহতদের বাড়িতে চলছে মাতম। আদরের সন্তানকে হারিয়ে স্তব্ধ মা-বাবা। শুধু স্বজন নয়, প্রতিবেশী-বন্ধুরাও শোকে স্তব্ধ। ওই ভবনে আর কেউ নিখোঁজ নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ। আগুনে পোড়া এফ আর টাওয়ারের সামনে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দাঁড়িয়েছিল হাজারো মানুষ। মন খারাপ করে পোড়া দাগ আর কাচ ভাঙা ভবনের দিকে তাকিয়েছিলেন তারা। সবার চেহারায় যেন স্বজন হারানোর ছাপ। এদের মধ্যে নির্বাক দাঁড়িয়েছিলেন মাঝবয়সী আহসান উল্লাহ। থাকেন বনানী সি বøকের ৪ নম্বর সড়কে। ঢাকার বাইরে থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় আসতে পারেননি। সকালে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছে ভবনটির সামনে আসেন। তিনি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ৯ তলায় আমার এক আত্মীয়ের সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস ছিল। ওই অফিসের একজন স্টাফ মারা গেছেন। খুব খারাপ লাগছে। আল্লাহ জাতিকে এমন বিপদে যেন আর না ফেলেন।

মোমিন নামে একজন জানান, রাতভর এফ আর টাওয়ারের সামনে শোকার্ত মানুষের ভিড় ছিল। কেউ ছিলেন স্বজনের খোঁজে আবার কেউ ছিলেন উৎসুক। গতকাল এফ আর টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ২৩ তলা ভবনটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হালকা নীল রঙের গ্লাসে মোড়া পুরো ভবন। থাইগ্লাস আর ইস্পাতের কাঠামো দেখেই এর আভিজাত্য ঠাওর করা যায়। প্রতিটি তলার বাইরের অংশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থরে থরে বসানো আছে এখনো। অথচ ভবনটির মধ্যভাগ এখন শ্মশানরূপ।

যে ভবনে সকাল থেকেই শত শত প্রাণের সম্মিলন ঘটত, সে ভবন আজ প্রাণহীন। বৃহস্পতিবার সকালে যেখানে আলোর ভুবন ছিল, ২৫টি প্রাণ কেড়ে নিয়ে সেখানে এখন মৃত্যুক‚পের নিশানা। ভবনটির ৯ তলা থেকে ১১ তলা পুড়ে অঙ্গার। আগুন আর ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত আরো কয়েকটি তলা। গ্লাস ভাঙা প্রায় প্রতিটি তলাতেই। আগুনের লেলিহান শিখা যে সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারে, তারই সাক্ষী বহন করছে এফ আর টাওয়ার। এ ভবনের ৬ তলায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আরিফ। অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি ভবনেই ছিলেন। আগুন লাগার কথা শুনেই সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে আসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজ কর্মস্থলের পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছেন। শুক্রবার সকালে ফের আসেন তিনি।

আরিফ বলেন, দুই বছর হয় এখানে যোগদান করেছি। ভবনটি নিজের মনে হয়েছে এতদিনে। অথচ এখন পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে। কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবকটি তলাই। ভবনটি হয়তো ঠিক হবে অল্পদিনে, কিন্তু পোড়া মানুষের গন্ধ তো আর সহজে দূর হবে না।

ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এসএম মোস্তাক আহমেদ বলেন, ২৫ জনের মরদেহ আমরা শনাক্ত করেছি, তাদের মরদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমাদের লিস্টে ৭৩ জনের মতো আহত আছেন। এ ছাড়া কম-বেশি আরো অনেকে আহত হয়েছিলেন। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ নেই। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন শ্রীলঙ্কার নাগরিক।

শুক্রবার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় এফ আর টাওয়ারে প্রবেশ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও মালিকরা। এ সময় তাদের ছবি না তোলার জন্য অনুরোধ জানায় পুলিশ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দু’জন করে প্রতিনিধিকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

এফ আর টাওয়ারে হতাহত আর কেউ নেই: এফ আর টাওয়ারে হতাহত আর কেউ অবশিষ্ট নেই বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোর তল্লাশি শেষে শুক্রবার দুপুরে এ তথ্য জানান ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহজাহান।

তদন্ত করবে পাঁচ কমিটি: এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত করতে পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক চারটি কমিটি গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। ৭ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এফ আর টাওয়ারের অনুমোদন ও নির্মাণে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা, তা তদন্ত করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

নষ্ট ছিল ফায়ার অ্যালার্ম: দগ্ধদের মধ্যে আবু হোসেন নামে একজন বলেন, আমরা ১৩ তলায় প্রায় ২০-২৫ জন আটকে গিয়েছিলাম। আমার অফিস ছিল ১২ তলায় ডার্ড গ্রুপে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা আগুনের খবর পাই। কিন্তু তখন কোনো অ্যালার্ম ছিল না। ফায়ার অ্যালার্মটা আগে থেকেই নষ্ট ছিল। ১৩ তলায় ধোঁয়ার কারণে আমাদের প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তখন আমরা চেয়ার দিয়ে জানালার গ্লাস ভেঙে ফেলি। বেঁচে থাকার জন্য সামান্যতম অক্সিজেনটুকু পাচ্ছিলাম। আর এর পরেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এগিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করেন।

মায়ের সঙ্গে শেষ কথা বলেন আবির: অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার আনজির সিদ্দিক আবির। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে ১৬ তলা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তিনি মিকা সিকিউরিটিস লিমিটেড কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। এফ আর টাওয়ারের ১৪ তলায় অফিস ছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে মাকে ফোন করেন আবির। বলেন, বেতন পেয়ে বাড়ির সবার জন্য নতুন কাপড় কিনব। এর কিছুক্ষণ পরই ভবনটিতে আগুন লাগে। পরে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে শেষবারের মতো ফোন করে পরিবারকে বিষয়টি জানান আবির। ফোন চালু রেখে ভবনের বাহিরে থাকা লোকদের কাছে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল। সবার কাছে দোয়া চায়। এর কিছু সময় পর তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

ভাই, প্রচণ্ড ধোঁয়া, শ্বাস নিতে পারছি না: মিজানুর রহমান লিটন এফ আর টাওয়ারের ১০ তলায় একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভবনটিতে আগুন লাগার সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। আগুন লাগার পর বের হতে না পেরে এক পর্যায়ে বাড়িতে ভাইয়ের কাছে ফোন দেন। ‘ভাই, প্রচণ্ড ধোঁয়া, নিশ্বাস নিতে পারছি না- এ কথা বলার পরই লিটনের ফোন বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্বজনরা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তার লাশ শনাক্ত করেন। কিছুদিন আগে তার একটি ছেলে হয়েছে।

আপা, বিপদে আছি, বেঁচে থাকলে দেখা হবে: আগুন লাগার পর ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় দুপুর দেড়টায়। ভাই ফোন দিয়ে বলে, আপা, দোয়া কইরো। খুব বিপদে আছি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।’ সেই ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি তারিকুর নাহার গিনির। অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন গিনির ভাই আনজির সিদ্দিকী আবির। তিনি ওই ভবনের ১৪ তলায় চাকরি করতেন।

বাড়িতে চলছে মাতম: অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের গ্রামের বাড়িতে চলছে মাতম। আদরের সন্তানকে হারিয়ে স্তব্ধ মা-বাবা। শুধু স্বজন নয়, প্রতিবেশী-বন্ধুরাও শোকাহত। রংপুরে স্ত্রীর কাছে মুঠোফোনে বাঁচানোর শেষ আকুতি জানিয়েছিলেন মোস্তাফিজার রহমান। ধোঁয়ায় তার মৃত্যু হয়। পীরগঞ্জে তার বাড়িতে শোকার্ত মানুষের ঢল। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন স্ত্রী। দিনাজপুর শহরের বালুয়াডাঙ্গার আব্দুল্লাহ আল মামুন। চাকরির কারণে স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যা তানহা ও তাহিয়াকে নিয়ে বসবাস করতেন ঢাকায়। কাজ করতেন হেরিটেজ এয়ার লাইন্স নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে। ঘটনার সময় আগুন থেকে বাঁচতে জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তার। শোকে স্তব্ধ মা ও স্বজনরা।

এফ আর টাওয়ারে আগুনে নিহতদের আরেকজন কুষ্টিয়ার ইকতিয়ার হোসেন মিঠু। ১১ তলায় একটি অফিসে কর্মরত ছিলেন তিনি। তার অকাল মৃত্যুতে আড়াই বছরের সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী সালমা। পাবনার আতাইকুলার চরপাড়া গ্রামের রাব্বির বাবা বলেন, আজকে আমাকে ছেলের মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে দাফন করতে হচ্ছে। আমি আশা করেছিলাম আমার ছেলে আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে। মাত্র দুদিন আগে নিজেদের তৃতীয় বিয়েবার্ষিকী পালন করা জারিন তাসনিম বৃষ্টির যশোরের বাড়িতেও চলছে মাতম।

মাকসুদুর রহমান জামি ও রুমকি রহমান দম্পতির আকস্মিক প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন তাদের স্বজন। রাজধানীর ফরিদাবাদে তাদের বাসায় চলছে মাতম।

জোরে শ্বাস নিতে পারছেন না সবুর: আমার স্বামীর (আব্দুস সবুর খান) শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। তাই জোরে শ্বাস নিতে পারছে না। আজ (গতকাল) সকালে একবার একঘণ্টা চেম্বারে অক্সিজেন দিয়েছি। এভাবে আরো ৪/৫ দিন দিতে হবে। শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর কথা বলেন রাবেয়া আক্তার। বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন তৌকির হোসেন নামে আরেকজন। অক্সিজেন দেয়া অবস্থায় থাকা এই রোগীর সহধর্মিণী শাহীন হাসনাতকে প্রচণ্ড মর্মাহত অবস্থায় দেখা গেছে।

উদ্ধারের গল্পটি শোনালেন সেই নায়ক: বৃহস্পতিবার বিকেলের দিক থেকেই ফেসবুকে বেশকিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। তার মধ্যে একটি ছিল এক তরুণীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার চিত্র। সে ছবিটাতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসের এক যোদ্ধার পিঠের ওপর এক তরুণী। ছবিতেই স্পষ্ট- কতটা কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে ফিরলেন তিনি। তার চোখেমুখে ভয়-আতঙ্ক। তাকে টেনে নিয়ে আসছেন যে ব্যক্তি তার অভিব্যক্তিও হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে, শিহরিত করছে মানুষকে। শুক্রবার কথা হয়েছে অগ্নিযোদ্ধা সেই নায়কের সঙ্গে। তিনি হলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল। তিনি বলেন, টেলিভিশনে যখন দেখলাম আগুনের ভয়াবহতা এবং এখানে অনেক মানুষের জীবনের বিষয়…তখন আমরা মুভ করলাম ঘটনাস্থলের দিকে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা আগুন নেভানোর পাশাপাশি উদ্ধার কাজও চালিয়ে যাব।

আব্দুল জলিল বলেন, তখন তিনটি ল্যাডার ইউনিট দিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছিল এবং আরেকটিতে আমি এবং আরেকজন ছিলাম। ওই ল্যাডার ইউনিটে নিয়ে যখন ১২ বা ১৩ তলায় পৌঁছালাম তখন একটি মেয়ে বাঁচান বাঁচান বলে কাঁদছিল। আমরা তাকে কিছুটা আগাতে বলি সে জানায় সে হাঁটতে পারবে না, তার পায়ে আঘাত রয়েছে। সেই সঙ্গে মেয়েটা ভয়েও ছিল। সে শুধু একটা কথাই বলছিল আমার মা নিচে আছে, মায়ের কাছে যাব। এরপর ওই তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে নেন আব্দুল জলিল। এ সময় সে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে হালকা করার জন্য জিজ্ঞাসা করি, কী করেন? সে জানায় চাকরি করে। এরপর তার বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলে আমার মা নিচেই আছে। আব্দুল জলিল বলেন, মেয়েটি বাসায় চলে যেতে চাইলে আমি তাকে বলি প্রথমে হাসপাতালে যান, পরে বাসায় যাবেন।

আট বছর আগেও আগুন লাগে: এফ আর টাওয়ারে আট বছর আগেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভবনে আগুন প্রতিরোধে করণীয় কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা মেট্রো) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, আট বছর আগে এই ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ অনুযায়ী কোনো পরিবর্তন আসেনি ভবনে। ফলে ফের আগুন লাগল এবং ২৫ জন মানুষ মারা গেল। সামান্য এস্টিংগুইসার পর্যন্ত নেই এই ভবনে। যেখানে প্রতি ফ্লোরে অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকা দরকার। এই ধরনের ভবনে সাধারণত জরুরি বের হওয়ার জন্য নির্গমনের পথ থাকে সেটিও নেই এখানে।

ঢামেক বার্ন ইউনিটে ভর্তি দগ্ধরা আশঙ্কামুক্ত: সামন্তলাল সেন : ডা. সামন্তলাল সেন বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনে দগ্ধ যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি আছেন, তারা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন। তিনি বলেন, ‘বার্ন ইউনিটের কেউই এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেই। রেজাউল নামের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাকে হাসপাতালের মূল ভবনের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।’ গতকাল শুক্রবার তিনি এসব কথা জানান।

ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ‘আমাদের এখানে মোট সাতজন রোগীকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল। আবুল হোসেন ও রেজাউর রহমান নামে দুজনকে সকালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রেজওয়ান আহমেদ নামে আরেকজনের অবস্থা শঙ্কটাপন্ন, তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তার শরীরের ১০ থেকে ১২ শতাংশ পোড়া; দুই পায়ের ঊরু ও দুই হাতের হাড় ভাঙা এবং পিঠের কিছুটা অংশে মাংস নেই। রাতে সেটা অপারেশন করা হয়েছে। এখন বিশেষভাবে চিকিৎসাধীন আছে। এ ছাড়া বাকি যারা আছেন তাদের সবাই ঝুঁকিমুক্ত। এই মুহূর্তে বার্ন ইউনিটে সর্বমোট চারজন আছেন।’ তারা হলেন- অনুপম দেবনাথ, আব্দুস সবুর খান, সাব্বির আলী মৃধা ও তৌকির হোসেন। এর মধ্যে অনুপম দেবনাথকে কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে আনা হয়। ‘এই চারজনকে আমরা বার্ন ইউনিটের দোতলায় আলাদা কক্ষে নিয়ে স্পেশাল চিকিৎসা দিচ্ছি।’ এ ছাড়া জরুরি বিভাগে ভর্তি আছেন ফায়ার কর্মকর্তা উদ্দীপন ভক্ত, হাবিবুল্লাহ খান ও নিলীমা। বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আল ফারুক তমাল নামে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পোড়া ছিল।’

সামন্তলাল সেন বলেন, ‘সকালে সরকারের নির্দেশে কুর্মিটোলা হাসপাতালে রোগীগুলোকে দেখতে যাই। সেখানে ১১ জন রোগী ভর্তি আছে। তাদের অবস্থা ভালো। তারা কেউ বার্ন প্যাশেন্ট না।’ এই চিকিৎসক বলেন, ‘এ ধরনের আগুনের ঘটনা দুঃখজনক। এগুলো প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ২৩ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারের ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন অন্তত ৫৯ জন।

সূত্র: মানবকণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *