বার্তা অনলাইন ডেক্স: সৃজিত মিথিলা দু’জন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন একটি বিশেষ দিনে। দিনটি ৬ ডিসেম্বর। ২৭ বছর আগে এই দিনটিতে ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দিয়েছিল হিন্দু মৌলবাদীরা। প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম মৌলবাদীরা বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকানপাট মন্দিরে হামলা করে। শত শত হিন্দু পরিবার আশঙ্কায় আর্তনাদ করেছে, মাতৃভূমি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দিনটিতে সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং রাফিয়াত রশিদ মিথিলার মিলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। ভারত এবং বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের একাংশের মধ্যে যে ঘৃণা, যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ- সেটির বিরুদ্ধে দুটি দেশের হিন্দু এবং মুসলমান দুই নর-নারীর পরস্পরকে ভালোবাসায় এবং নিবিড় বন্ধনে জড়ানোটিই তীব্র প্রতিবাদ।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন সংশোধন করতে একটি বিল ভারতের পার্লামেন্টের লোকসভায় পাস হয়েছে। ভারত সরকার জানিয়ে দিয়েছে, মুসলিমপ্রধান দেশে যে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় কারণে হিংসের শিকার হন, তাদের নাগরিকত্বদান করার উদ্দেশ্যেই এই সংশোধনী। খোলাসা করে বলতে গেলে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই এই বিল। আরও একটু খোলাসা করে বলতে গেলে, মুসলমান ছাড়া বাকি সব অভিবাসীর জন্য ভারতের দুয়ার খোলা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। আপত্তির কারণ, সংবিধানের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে ভারতের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে যে সমতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, এই বিল তার পরিপন্থী। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে। সেটি ছিল উপমহাদেশটির জন্য এক চরম দুঃসময়। ১০ লক্ষ হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে খুন করেছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা আর হিংসে বন্ধ করার জন্যই নাকি ছিল দেশ ভাগ। দুঃসময় এখনও কাটেনি।
সারা ভারতবর্ষে জানি না ক’কোটি মুসলমান অভিবাসী অবৈধভাবে বাস করছে। তাদের সবাইকে ধরে ধরে দেশ থেকে তাড়ালে জানি না তারা কোথায় ফিরবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধভাবে ঢুকে যে গরিব মুসলমানেরা যুগের পর যুগ বাস করছে, উপার্জন করছে, ভিটেমাটি কিনেছে, ঘরবাড়ি গড়েছে, পরিবার বাড়িয়েছে- সব ফেলে তাদের চলে যেতে হবে কারণ তারা মুসলমান।
দরিদ্র বলে ভাগ্য ফেরাতে নিজের দেশ তারা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষ চিরকালই এক স্থান ত্যাগ করে আরেক স্থানে পাড়ি দেয়, উন্নত জীবনের আশায়। ভারতীয়রাও উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দেয় এশিয়ার ধনী দেশগুলোয়, ধনী মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ আমেরিকায়। সেসব দেশে স্থায়ীভাবে বাস করে। ইউরোপ আমেরিকায় বিভিন্ন দেশ থেকে এমনকি ভারত থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের মানবিক কারণে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। দরিদ্র লোক যখন অর্থনৈতিক কারণে নিজের দেশ ত্যাগ করে, তারা কোন দেশে যাচ্ছে, সে কোন ধর্মাবলম্বীদের দেশ, তা দেখে না। বাংলাদেশের দরিদ্র মুসলমান দেখে না তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশে বাকিটা জীবনযাপন করতে যাচ্ছে, তারা দেখে কোথায় গেলে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা জুটবে। ভারতীয় হিন্দু যখন দেশ ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেয়, তারা দেখে না এ ভূমি মুসলমানের ভূমি, বা যখন ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি দেয়, তারা দেখে না এ ভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক খ্রিস্টান। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কাছে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তাÑ কিছুই বড় নয়। মুসলমানেরা উন্নত জীবনের আশায় হিন্দুর দেশে, খ্রিস্টানদের দেশে, বৌদ্ধদের দেশেই প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছে। হিন্দুও তাই করছে। ধর্ম নিয়ে যতই গৌরব করুক মানুষ, স্বাধীনতা এবং সচ্ছলতার সামনে ধর্মের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। দিন-রাত আমেরিকাকে গালি দেওয়া কট্টর মুসলমানকে দেখেছি আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেলে আনন্দে আত্মহারা। কোথায় যায় তখন তার ধর্মের অহংকার? বিধর্মীর দেশের সুযোগ সুবিধে, নিশ্চিতি আর নিরাপত্তা উপভোগের জন্য তখন সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে যায়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সীমান্তে দেয়াল তুলতে চাইছেন। ইউরোপও ব্যস্ত কাকে থাকতে দেবে, কাকে দেবে না- এ নিয়ে। ভারতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি হচ্ছে, নাগরিক বিল পাস হচ্ছে। যেন এর চেয়ে বড় এবং জরুরি কাজ এই মুহূর্তে কিছু নেই ভারত সরকারের। যেন দেশের সব নাগরিকের পেটে ভাত জুটছে, যেন সবারই মাথার ওপর ছাদ আছে, গায়ে কাপড় আছে, যেন সবারই শিক্ষা স্বাস্থ্য সব জুটছে, যেন দেশে কোনও বেকার নেই। নারী-পুরুষে বৈষম্য নেই, বর্ণ বিদ্বেষ বলতে কিছু নেই। যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। শুধু অবৈধ মুসলমান অধিবাসীরাই দেশের জন্য বিরাট এক সমস্যা। এদের তাড়ালেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল একবার, ধর্মের ভিত্তিতে আর কতকাল মানুষ ভাগ হবে, তা কেউ জানে না।
এই সময়ে সৃজিত আর মিথিলার মিলন, ভারত আর বাংলাদেশের মিলন, হিন্দু আর মুসলমানের মিলন। এই মিলনে সাম্প্রদায়িকতার পিঠে চাবুক পড়বে, এই মিলনে ঘুচবে সংস্কার, ছিঁড়বে কাঁটাতার, মরবে বিদ্বেষ। আসলে হয়তো কিছুই ঘুচবে না, ছিঁড়বে না, মরবে না,- কিন্তু ঘৃণার বিরুদ্ধে ছোট হলেও একটি প্রতিবাদ রচিত হলো। ঘৃণা আর বিদ্বেষকে দূর করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। কুসংস্কারকে দূর করতে হয় মুক্তচিন্তা দিয়ে। ধর্মের কট্টরপন্থাকে দূর করতে হয় যুক্তিবাদ দিয়ে।
ভারতে যারা হিন্দু রাষ্ট্র চাইছে, তাদের যুক্তি হলো, মুসলমানদের বাস করার জন্য প্রচুর দেশ আছে পৃথিবীতে, হিন্দুর জন্য কেবল একটিই দেশ। বহিরাগত মুসলমানেরা প্রায় ৭০০ বছর রাজত্ব করেছে। হাজারও হিন্দু-মন্দির ভেঙ্গেছে, হিন্দুদের অত্যাচার করেছে, হিন্দুর দেশে বসে হিন্দুর কাছ থেকে কর নিয়েছে। মুসলমানেরা যদিও ভারতে বাস করে ভারতীয় বনে গিয়েছিল, ইংরেজরা তা করেনি। লুটপাট করেছে, নির্যাতন করেছে, গণহত্যা করেছে। তারপরও প্রচুর ভারতীয়র মুসলমান শাসকদের ওপর যত রাগ, তত রাগ ইংরেজ শাসকদের ওপর নেই।
পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে মুসলমানদের নিয়ে। স্বাধীন ভারত সব ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের কোনও স্থান ভারতবর্ষে নেই। কিন্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুযায়ী শুধু অমুসলমানরা নির্যাতিত হলেই নয়, মুসলমানরা নির্যাতিত হলেও ভারতের তাকে আশ্রয় দেওয়ার কথা। মুসলমানরা তো সবাই মৌলবাদী বা কট্টরপন্থি নয়। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় উদারনৈতিক, মুক্তমনা, সমাজ- সংস্কারক মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে মুসলিম মৌলবাদী দ্বারা। সবাই তো আর ইউরোপ আমেরিকার ভিসা পায় না। অন্য মুসলিম দেশগুলো তাদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। বাঁচার জন্য প্রতিবেশী ধর্মনিরপেক্ষ দেশই তাদের জন্য ভরসা। তারা যাবে কোথায়, হয় মুখে কুলুপ আঁটতে হবে, নয় মরতে হবে।
সৃজিত আর মিথিলার অর্থবহ বিবাহবন্ধন অসহিষ্ণু হিন্দু এবং মুসলমানকে বলছে, ঘৃণা নয়, ভালোবাসাই সমাধান। নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস ত্যাগ না করেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে একত্র বাস সম্ভব। যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার। এ কারণে কোনও সম্পর্কে চির ধরার কথা নয়। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈষয়িক, ব্যবহারিক, সাংগিতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে মানুষ একত্র বাস করছে না? তবে ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন হলে এত কেন অনীহা, এত কেন খুনোখুনি?
শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা মুক্তমনা প্রতিভাবান দুই ব্যক্তিত্ব সৃজিত আর মিথিলা এই সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনের সময় নিশ্চিন্তের নির্ভাবনার নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছেন আমাদের। এইরকম হিন্দু মুসলমানের বিয়ে আরও হোক, দুই দেশের, দুই সংস্কৃতির মানুষের মিলন আরও হোক। এই মিলনই বিরোধ আর বিচ্ছেদ ঘুচিয়ে শান্তির সহাবস্থান আনবে। আজ না হোক, কাল। যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক, আমরা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে চলেছি। আজ না হয় হিন্দু মুসলমানের মিলন নিয়ে অসন্তোষীরা কটাক্ষ করছে, ভবিষ্যতে এই মিলনই হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন। মানবতার জয় একদিন না একদিন হবেই।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।