বার্তা প্রতিনিধি: পর পর দু’বার সংসদে বিরোধী দলের আসন অলঙ্কৃত করা জাতীয় পার্টি ঝিমিয়ে পড়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শুধু বনানী কার্যালয়ের ছোট একটি কক্ষে সপ্তাহে দু’একটি প্রেস ব্রিফিং ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। বিকল্প হিসেবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম সক্রিয় রাখছেন দলটির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। সিনিয়র নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ আর হতাশা। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর কাকরাইলে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেতাকর্মীদের আনাগোনায় মুখর ছিল; কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বনানীর কার্যালয়েও অনেকটা সুনসান নীরবতা। চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশ নিতে আগ্রহ নেই নেতাকর্মীদের।
১ জানুয়ারি দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী চলে গেল নীরবে। জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা দলবিমুখ হয়ে পড়েছে। পার্টির পক্ষ থেকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাননি পার্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। যাননি পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানাতে। নেতাকর্মীরা বলছেন, এরশাদ পুরোপুরি সুস্থ থাকলে দল এমন কর্মসূচিবিমুখ হতো না। এভাবে দল চলতে থাকলে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্যাডসর্বস্ব দলে পরিণত হতে। জানতে চাইলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বেই দল চলে। এ ছাড়া আমরা এখন সংসদের কার্যক্রমে ব্যস্ত রয়েছি। সংসদের অধিবেশন শেষ হলেই পার্টির চেয়ারম্যানের অনুমোদন সাপেক্ষে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়ার ইচ্ছা রয়েছে।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ১ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সভা-সমাবেশ না করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক সপ্তাহ বা ১৫ দিন পর সমাবেশ, র্যালি বা আলোচনা সভা করা যেত। দলীয়ভাবে কোনো পোস্টারও করা হয়নি। ২০ জানুয়ারি পুরান ঢাকায় হতাহত হয়েছে। প্রতিটি দলের পক্ষ থেকে সেখানে যাওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি টিমের স্পটে এসে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল। তবে, প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার পরেরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের খোঁজ নিতে যান জি এম কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে উপস্থিত জাপা নেতারা একাধিকবার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের স্পটে যাওয়ার কথা বললেও যাননি জিএম কাদের। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হওয়ার দিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা হাসপাতালে যান। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের পরদিন ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে গেলেও দেখা পাননি। এর আগেই তাকে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
জাপার নেতাকর্মীর আরো জানান, জাতীয় পার্টি সবকিছুতেই ঝিমিয়ে পড়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রার্থীকে এতিমের মতো মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দলীয় প্রার্থী হিসেবে শুধু শাফিন আহমেদকে লাঙ্গল প্রতীকটাই দেয়া হয়েছে, আর কিছু নয়। দলের শীর্ষ নেতারা কেউ শাফিন আহমেদের প্রচারণায় অংশ নেননি। কেন্দ্র থেকেও কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম জয়ের প্রচেষ্টায় পার্টির একটি অংশকে মাঠে নামিয়েছিলেন। বাকিটা শাফিন আহমেদের ব্যক্তি ইমেজে ভোট পেয়েছেন। হাসিবুল ইসলাম জয় মানবকণ্ঠকে বলেন, এখানে শাফিন কোনো বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে লাঙ্গল। এ লাঙ্গল প্রতীককে জয়যুক্ত করতে সবাই যদি সম্মিলিতভাবে মাঠে নামত, তাহলে ফলাফল আরো ভালো করতে পারতাম। তারা আরো জানান, সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নিয়ে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। বিএনপি এতে অংশ নিচ্ছে না। জাতীয় পার্টি শক্তভাবে মাঠে অবস্থান নিয়ে ভালো ফলাফল করতে পারত। কিন্তু নির্বাচনী মাঠে নেই জাপার প্রার্থীরা। জাতীয় পার্টির যুগ্ম দফতর সম্পাদক রাজ্জাক খান জানিয়েছেন, দলীয় মনোনয়ন পেতে মাত্র ১৩০ জন ফরম উত্তোলন করেছেন। এইচ এম এরশাদ বর্তমানে অনেকটা সুস্থ থাকলেও সিঙ্গাপুরে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার সুস্থতা কামনায় তিনটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত হননি দলটির সিনিয়র নেতারা। তবে ওই সময়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এবং গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ঠিকই অংশ নিয়েছিলেন নেতারা। শুধু অংশই নেননি, প্রথম কাতারে বসার জন্য সকাল সকাল রওনা হয়েছিলেন। কেন্দ্রের কোনো কর্মসূচি না থাকায় পার্টির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, এরশাদ অসুস্থ হওয়ার পর নতুন নেতৃত্ব আসার পর থেকেই পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদসহ দলের একটি বড় গ্রুপ দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, এইচ এম এরশাদ ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, তার অবর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন তার ভাই পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
তাহলে বেগম রওশন এরশাদের অবস্থান পার্টিতে কোথায়। এ অবস্থার উত্তরণ না ঘটাতে পারলে সম্ভাবনাময় দলটি আগামীতে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সার্বিক বিষয়ে জানতে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মানবকণ্ঠ