Thursday, April 25বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

প্রায় ৫০ কোটির টাকার মালিক ইছাহাক আলীর প্রতারনার কৌশল মন্ত্রী-এমপি ও সংসদ ভবন

বাংলার বার্তা: কে এই প্রতারক ইছাহাক আলী? প্রায় ৫০ কোটির টাকার মালিক ইছাহাক আলীর প্রতারনার কৌশল মন্ত্রী-এমপি ও সংসদ ভবন যিনি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু খোদ সচিবালয়ে বসে বৈঠক করতেন। নিয়মিত যাতায়াত ছিল সংসদ ভবনেও। চলাফেরায় কেতাদুরস্ত। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন। এমনকি একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের নামেও কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে ইছাহাক আলী মনি নামের এই প্রতারক গত কয়েক বছরে প্রায় ২০-২২ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রায় দেড় ডজন প্রতারণার মামলা রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল ডজন খানেক। দুই-একবার জেলেও যেতে হয়েছে। কিন্তু কৌশলে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও নতুন কৌশলে প্রতারণা করতেন তিনি। সবশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভাড়ায় নেওয়া একটি গাড়ি নিজের জানিয়ে বিক্রি করতে গিয়ে তেজগাঁও থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তেজগাঁও থানার রিমান্ড শেষে বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) রিমান্ডে আছেন তিনি।

গ্রেফতার করার পর তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান বলেন, ‘এক ব্যক্তির কাছ থেকে গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে বিক্রির সময় আমরা ইছাহাককে গ্রেফতার করি। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর তার প্রতারণার শিকার অনেক ব্যক্তি আমাদের কাছে এসেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে ইছাহাক প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে কেনা কোনও সম্পদের হদিস সে দিতে পারেনি। তাকে আরো জিজ্ঞাসাবদের জন্য আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাসিন্দা ইছাহাক ২০০৬ সালে একটি এনজিও’র নামে প্রতারণা শুরু করেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে অফিস খোলার পর তিনি সিমফোনি নামে একটি মোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকার মোবাইল হাতিয়ে নেন। সেই সময় প্রতারণার মামলায় এক মাস জেলও খাটেন তিনি। কিন্তু কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও প্রতারণা শুরু করেন। ওকাপিয়া নামে আরেকটি মোবাইল সেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোবাইল নেওয়ার নামে ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

বিভিন্ন সূত্রে আরো জানা যায়, ইছাহাক আলী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে তিনি সংসদ ভবনে ওই সংসদ সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। এছাড়া সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গেও তার সখ্য রয়েছে। ওই মন্ত্রীর সঙ্গে তিনি সচিবালয়ে বৈঠকও করতেন। সেসব বৈঠকে বিভিন্ন লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, যাতে লোকজন তার ওপর আস্থা রাখতে পারে। এসব কৌশলেই তিনি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন।

এদিকে ইছাহাক আলী দ্য ডেইলি মর্নিং বাংলাদেশ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের নামে প্রতারণা শুরু করেন। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় প্রায় চার হাজার বর্গফুটের একটি অফিস ভাড়া নিয়ে নেন। অফিসের জন্য অটবি ও হাতিল থেকে ফার্নিচার কেনেন। অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইনার থেকে শুরু করে রঙমিস্ত্রি ও টাইলস মিস্ত্রিসহ সবার সঙ্গেই প্রতারণা করেছেন তিনি। এমনকি ভবন মালিকের ভাড়াও দেননি। প্রত্যেককে একটি করে চেক ধরিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু তার ওই ব্যাংক হিসাবে কোনও লেনদেন ছিল না। হাতিল ও অটবি তার কাছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা পাবে। দেশের শীর্ষ টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনও বাদ যায়নি। গ্রামীণফোনের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার সিম ও দেড় হাজার মোবাইল সেট নেন তিনি। তাদেরও চেক ধরিয়ে দিয়েছেন ইছাহাক, যে চেকের হিসাব নম্বরে অর্থ লেনদেন ছিল না বললেই চলে। তার নামে নামে বেনামে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে একাউন্টের খবর পাওয়া গেলেও সেগুলোতে কোন অর্থ পাওয়া যায়নি।

পুলিশ সূত্র আরো জানায়, ইছাহাক আলী তার সবশেষ প্রতারণার কৌশল হিসেবে দ্য ডেইলি মর্নিং বাংলাদেশের জন্য সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরে মোটা বেতনে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে প্রত্যেককে একটি করে গাড়ি দেওয়ার অফার দিয়েছিলেন। অফিসিয়াল গাড়ি দেওয়ার বিনিময়ে তিনি জামানত হিসেবে দুই লাখ করে টাকা নিতেন। ভাড়ায় নেওয়া এসব গাড়ি প্রতিনিধিদের কাছে ধরিয়ে দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার কৌশল। ভাড়ায় নেওয়া একটি গাড়ি বিক্রি করতে গিয়েই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি।

প্রতারক ইছাহাক আলীর প্রতারণার শিকার অসীম ঘোষ নামের একজন ভুক্তভোগী জানান, পরিচয়ের সূত্র ধরে ইছাহাক তাকে বাংলাদেশ সেভ ট্রানজিট সিস্টেম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরশিপ দেওয়ার নামে নগদ ৩৪ লাখ টাকা নেন। এছাড়া তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকার মালামাল সরবরাহ করেছিলেন। এর আগে ইছাহাক তাকে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট সচিবালয়ে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙার সঙ্গে বৈঠক করেন। এ কারণে তিনি ইছাহাকের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন। এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন সবই ছিল প্রতারণার কৌশল।

তিনি তার স্বজনদেরও প্রতারনার হাত থেকে রেহায় দেননি। তাই ইছাহাক আলী মনির প্রতারণার সঙ্গী ছিল তার স্বজনরাও। বাবা শহীদুল ইসলামকে তিনি বিভিন্ন এনজিওর চেয়ারম্যান বানাতেন। আর স্ত্রী কবিতা ছিল দ্য ডেইলি মর্নিং বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া তার বোনের স্বামী মনসুর আলমসহ এক বোনও প্রতারণার সঙ্গে জড়িত।

তেজগাঁও থানার উর্ধ্বতন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ইছাহাক আসলে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হোতা। প্রতারণা মামলায় সহজেই জামিন পাওয়ার কারণে সে বারবার একই কাজ করে আসছিল। ভিন্ন ভিন্ন নামে সে প্রতারণা করতো। তার কারণে অনেক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়েছে। তার এই সংঘবদ্ধ চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

এদিকে আদালতে ভুক্তভোগীদের মামলার একজন আইনজীবী সোহেল রানা বলেন, ‘গ্রেফতারের পর ইছাহাককে ছাড়িয়ে নিতে প্রায় ২০ জন আইনজীবী আদালতে দাাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আদালত জামিন না দিয়ে রিমান্ড দিয়েছিলেন। আমরা তার বিরুদ্ধে অন্যান্য মামলায়ও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য আবেদন করেছি।

অন্য একটি সূত্র জানায়, ইছাহাক প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যে ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিতেন, সেগুলো তিনি এলিফ্যান্ট রোডের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করতেন। তার এই কাজে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সদস্য কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীও জড়িত। ইছাহাক গ্রেফতার হওয়ার পর এই চক্র তাকে তেজগাঁও থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টাও করেছিলেন। এদিকে ইছাহাক আলীর কিকি সম্পদ থাকতে পারে তার খোঁজখবরও নেয়া হচ্ছে জানান পুলিশের একজন কর্মকর্তা।

সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *