Friday, April 19বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

পদ্মা সেতু বাঙালি জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধ,অহংকার এবং গৌরবের প্রতীক

দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতির স্বপ্ন এখন বাস্তব। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অজুহাতে অর্থায়ন থেকে যখন সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক, তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে দুর্বার গতিতে পদ্মা সেতু উন্নয়নের কাজ ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাই পদ্মা সেতু বাঙালি জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধ, বাঙালিদের আবেগ, অহংকার এবং গৌরবের প্রতীক।

বিজ্ঞাপন
এটি আমাদের সামর্থ্য, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এটি বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যয়, দৃঢ় মনোবল, আস্থা, সততা, আত্মবিশ্বাস ও অসম সাহসের সোনালি ফসল। অবহেলিত দক্ষিণ বাংলার নতুন সম্ভাবনা, নতুন দিগন্ত, কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবনসংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপ পর্যটন উপযোগী হবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রাবন্দর ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। এটি শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকার, আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও যোগ্যতার প্রতীক। সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন এবং পুরো বিশ্বের এক বিস্ময়।

এই সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার (৭২ ফুট)। সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যা পৌঁছবে আশপাশের অনেক জেলায়। সেতুতে রয়েছে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট, সেতুর বাইরে আছে আরো প্রায় ২০০ বাতি। সেতুর দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩.৬৮ কিলোমিটারসহ মোট দৈর্ঘ্য ৯.৮৩ কিলোমিটার। সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (১৭ হাজার বর্গমাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে তিন কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটি বাংলাদেশের জিডিপির ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে ইতিহাসের অংশ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে দেশে-বিদেশে, চলছে নবজাতকদের নাম রাখার হিড়িক। নারায়ণগঞ্জে এ্যানি বেগম (২৪) নামের এক গৃহবধূ একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং তাদের নাম রেখেছেন স্বপ্ন (ছেলে), পদ্মা ও সেতু (দুই মেয়ে)। কুমিল্লার বরুড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঝুমুর আক্তারের যমজ মেয়ে সন্তানের নাম রাখা হয়েছে পদ্মা ও সেতু। এদিকে সেতু উদ্বোধনের দিন গোপালগঞ্জের প্রেমিক যুগল সারজিনা হোসাইন তৃমাকে বিয়ে করবেন তাঁর প্রেমিক সাভারের বাসিন্দা হাসান মাহমুদ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে, একটি বঙ্গবন্ধুর, অপরটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি। চলছে উদ্বোধনের বিশাল আয়োজন। যেখানে সমবেত হতে থাকবে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের। সেতুর দুই পাশের এলাকায় আত্মীয়-স্বজনও এরই মধ্যে এসে সেখানে ভিড় করেছে স্বচক্ষে দেখার জন্য। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঢাকা-মাওয়া দ্রুতগতির মহাসড়কের তিনটি সেতুতে টোল মওকুফ করেছে সরকার। এই তিন সেতু হচ্ছে—বুড়িগঙ্গা (পোস্তগোলা), ধলেশ্বরী ও আড়িয়াল খাঁ। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে স্মরণীয় করে রাখতে সারা দেশেই উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলায় জেলায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রচার, আতশবাজি ফোটানো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। উদ্বোধনে বেলুন উড়বে সারা দেশে, পদ্মা সেতু দেখা যাবে প্রজেক্টরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন শুভেচ্ছা। বিশ্বদরবারে এই সেতুর পটভূমি ও আগমনীবার্তা তুলে ধরতে আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজের নামকরণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর নামে।

এই সেতু হওয়ায় যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারসংলগ্ন গোলচত্বর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪০-৪৫ মিনিট। ফলে দক্ষিণবঙ্গে মানুষ সকালে ঢাকায় এসে বিকেলে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। তাই আগের চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা ঢাকায় বেশি হবে এবং সে কারণে শহরের মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

গতিময় পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যখন বিশাল গাড়ির বহর ঢাকায় ঢুকবে তখন যাতে যানজটের এই অবস্থা কোনোভাবে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। পদ্মা সেতুর দুই পাশে একাধিক বৃহদাকার বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা যেতে পারে। জরুরি খাদ্য, ওষুধ এবং অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া অন্য বাসগুলো ওই টার্মিনালে যাত্রা সমাপ্ত করা এবং ভবিষ্যতে ওই টার্মিনাল পর্যন্ত বিশেষ মেট্রো রেল চালু করা যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *