Friday, March 29বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে শাস্থির ঘটনায় কুড়িগ্রামের ডিসি প্রত্যাহার

বার্তা ডেস্ক: আমরা ভুলে যাই আমাদের দায়িত্ববোধকে। নিজেদের ক্ষমতাকে অন্যের উপর ঝাড়তে নেই। আর এইরকম এক অপ্রত্যাশিত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন প্রত্যাশিতভাবেই প্রত্যাহার হচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার দপ্তরের তদন্তে তার বিরুদ্ধে ‘বেশ কিছু অনিয়মের’ অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রত্যাহারের পথ ধরে চূড়ান্ত শাস্তিও হচ্ছে, আশা করা যায়। তিনি কুড়িগ্রামে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। নিজেকে কুড়িগ্রামের মহারানী ভেবেছিলেন, কুড়িগ্রামের সন্তান সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে তার প্রজা ভেবেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন, কুড়িগ্রামের মানুষ তার প্রজা নয়, বরং তাকে নিয়োগদাতা প্রজাতন্ত্রের মালিক। আরিফুল ইতোমধ্যে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, কুড়িগ্রাম থেকে সুলতানাকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে দুর্নামের বোঝা, মাথার ওপর ঝুলছে শাস্তির খড়্গ।

সুলতানার অপসারণ ‘প্রত্যাশিত’ এ কারণে যে, তিনি যেভাবে রাতের অন্ধকারে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধিকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন এবং ‘শাস্তি’ দিয়েছেন, তা যেন মধ্যযুগীয় সামন্ত মানসিকতাকেও হার মানায়। তার বরকন্দাজরা যেভাবে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে এবং ওই সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে নগ্ন করে মারপিট করেছে, তা কেবল কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষেই সম্ভব। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সুলতানা পারভীন স্পষ্টতই নিজের কদর্য রং চিনিয়েছেন। এমন মানসিকতার একজন জেলা প্রশাসক একুশ শতকের একটি রাষ্ট্রে জনপ্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।

আমরা দেখেছি, শুক্রবার মধ্যরাতের এত কাণ্ডের পর শনিবারও সুলতানা পারভীন মোবাইল কোর্ট বসিয়ে আরিফুল ইসলামকে সাজা প্রদানের প্রেক্ষাপট ‘ঠাণ্ডা মাথায়’ বর্ণনা করছিলেন। অথচ রাতের বেলা ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত’ বসানোই বেআইনি। যারা আরিফুল ইসলামকে চেনেন, তারা বলছেন তিনি ধূমপান পর্যন্ত করেন না। অথচ তার কাছ থেকে মদ ও গাঁজা উদ্ধারের গল্প ফাঁদা হয়েছিল! তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, তিনি মাদক সেবন করছিলেন; তা দেখার দায়িত্ব তো মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। বড়জোর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকতে পারে। জেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করবে কেন? ইতোমধ্যে স্থানীয় পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে যে বক্তব্য দিয়েছে, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পুরো অঘটনের নেপথ্য খলনায়িকা প্রত্যাহার হতে যাওয়া জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন নিজে।

‘ভ্রাম্যমাণ আদালত’ কীভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বসে, সেটাও বিস্ময়কর। এ ধরনের আদালতের চরিত্রই হচ্ছে অকুস্থলে বসবে এবং তাৎক্ষণিক কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সাজা ঘোষণা করবে। সুলতানা পারভীন ও তার সাঙাতরা অতটুকু ‘নিয়ম’ মানতেও নারাজ ছিলেন। যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই ‘রায়’ ঘোষণা করেছিলেন, তিনিও কি চোখের মাথা খেয়ে বসে ছিলেন?

নির্বাহী বিভাগের পক্ষে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ধরন নিয়ে বিভিন্ন সময়ই বিচার বিভাগের পক্ষে প্রশ্ন উঠতে দেখেছি আমরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এমন অপব্যবহার সেই প্রশ্ন আরও বড় করে সামনে আনছে। সেদিক থেকে সুলতানা পারভীন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা কেবল নিজের পদকে কলঙ্কিত করেননি, গোটা নির্বাহী বিভাগের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার এখতিয়ারের ব্যাপারে নির্বাহী বিভাগের অবস্থান দুর্বল করে তুলেছেন। আরিফুল ইসলামের ওপর হামলা ও বেআইনি মামলার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে এ ধরনের অঘটন আরও ঘটতেই থাকবে।

একসময় জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদে নারীর সংখ্যা ছিল সীমিত। জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদেও নারী ছিল বিরল। গত এক দশকে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন দেশে যে আটজন নারী জেলা প্রশাসক রয়েছেন, সুলতানা পারভীন তার অন্যতম। স্থানীয় সাংবাদিক ও নদীকর্মীদের কাছে তার প্রশংসাই শুনতাম। কিন্তু এখন স্পস্ট হলো, চকচক করলেই সোনা হয় না। আফসোস, সুলতানা পারভীন হয়ে উঠতে পারতেন মাঠ প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়নের অনুপ্রেরণা। তার বদলে তিনি এখন অন্যান্য নারীর জন্যও নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হবেন।

লিখতে গিয়ে আরেকজন নারীর কথা মনে পড়ছে, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত। সুলতানা পারভীনের কর্মস্থল যে বৃহত্তর রংপুরে, রোকেয়ার শিকড়ও সেখানেই গ্রোথিত। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘সুলতানার স্বপ্ন’। সেখানে তিনি সুলতানা নামে এক নারী চরিত্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের স্বপ্ন নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হতে পারে, ডিসি সুলতানা পারভীনও সেই উপন্যাস পড়েছেন; কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার বার্তাটি গ্রহণ করতে পারেননি।

পুরো চিত্র পরিষ্কার- রাষ্ট্রীয় অর্থে সংস্কার করা পুকুরের নামকরণ নিজের নামে করার স্বপ্ন দেখেছিলেন সুলতানা পারভীন। আরিফুল ইসলাম রিগান এ ব্যাপারে প্রতিবেদন লিখে ‘বাগড়া’ দিয়েছিলেন। ফলে সুলতানা চেয়েছিলেন আরিফুলকে ‘শাস্তি’ দিতে। এখন তাকেই উল্টো শাস্তি পেতে হচ্ছে। তিনি চেয়েছিলেন, পুকুরের নামকরণের মাধ্যমে কুড়িগ্রামে ‘অবিস্মরণীয়’ হয়ে থাকতে। এখনও কুড়িগ্রামবাসী তাকে নিশ্চয়ই স্মরণ করবে। তবে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে নয়; ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সুলতানার স্বপ্ন নয়, কুড়িগ্রামে গত দুই দিনে যা কিছু ঘটেছে, উপন্যাস হিসেবে লিখতে গেলে তার শিরোনাম হতে পারে ‘সুলতানার স্বপ্নভঙ্গ’।

লেখক ও গবেষক (সমকাল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *