Monday, September 16বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

যেভাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো জামায়াতে ইসলামী দল

কোন রাজনৈতিক দল দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও পরবর্তীতে সে দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকার উদাহরণ বেশ বিরল ঘটনা। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে সেটি কিছুটা ব্যতিক্রম।

এই দলটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী একটি আলোচিত এবং সমালোচিত নাম।

এই দলটিকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তীব্র বিতর্ক থাকলেও বাংলাদেশে তাদের সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জামায়াতে ইসলামী

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মূল উপজীব্য ধর্ম, সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির সাংগঠনিক অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কোন অস্তিত্ব ছিল না।

কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো ১৪টি ঘটনা
উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ৩রা মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন।

এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

তখন মি. সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলের আলোচিত-সমালোচিত পাঁচটি দিক

এরপর জামায়াতে ইসলামীর আত্মপ্রকাশ করা ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার।

কিন্তু জামায়াত ইসলামী সাথে সাথে আত্মপ্রকাশ করেনি।

রাজনীতিতে তারা কিছুটা কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করে।

যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধচারণ তখনো সবার মনে টাটকা ছিল, সেজন্য দলটি তাৎক্ষনিকভাবে জামায়াতে ইসলামী নামে আত্মপ্রকাশ করেনি।

এজন্য তারা ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল বেছে নেয়।

নতুন দল ধর্মভিত্তিক হবে না: জামায়াতের দলছুট নেতা গোলাম

ছবির উৎস, জামায়াতে ইসলামী ফেসবুক পেজ
ছবির ক্যাপশান, গোলাম আযম প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছেন।

ছিয়াত্তর সালের ২৪শে আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আই.ডি.এল) নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে।

জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এই দলটির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন।

ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছয়টি আসনে জয়লাভ করেন।

সে নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে প্রথমবারের মতো আসেন।

‘জামায়াত হারিয়ে যায়নি, পরিস্থিতি বুঝে এগুচ্ছে’

সে বছরই জামায়াতে ইসলামীর একটি কনভেনশন আহবান করা হয়।

উনিশশো উনআশি সালের মে মাসের ২৫, ২৬ এবং ২৭ তারিখে ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।

আব্বাস আলী খানের আহবানে সে কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় সাড়ে চারশো জন সদস্য।

সেই কনভেনশনে গোলাম আযমের একটি ভাষণ পড়ে শোনানো হয়।

এই সম্মেলনে একটি নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়।

সেটির ভিত্তিতে ১৯৭৯ সালের ২৭শে মে চার দফা কর্মসূচী নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে কর্মতৎপরতা শুরু করে।

এরপর থেকে জামায়াতে ইসলামী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশও করেছে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক তৎপরতা প্রকাশ্যে ছিল।

আন্দোলন সামাল দেবার জন্য জেনারেল এইচএম এরশাদ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনায় বসেন।

সে সময় জামায়াতে ইসলামীকেও আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন জেনারেল এরশাদ।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে জামায়াতে ইসলামী ১৮ টি আসনে জয়লাভ করে।

জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।

যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ

জামায়াতে ইসলামী সমর্থন না দিলে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হতো না।

তখন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়
ছবির ক্যাপশান, মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়
জামায়াতে ইসলামী ও গোলাম আযম

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ছিলেন গোলাম আযম।

উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ২২শে নভেম্বর ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান যান।

উনিশশো আটাত্তর সালে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে।

তবে তিনি আর ফিরে যাননি।

স্বাধীন বাংলাদেশে গোলাম আযম ১৯৮১ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসেন।

ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে সেখানেই প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন।

নাগরিকত্ব না থাকার পরেও জামায়াতে ইসলামী চলতো গোলাম আযমের নির্দেশনায়।

গোলাম আযমের জীবনী

জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত এক নেতা একেএম নাজির আহমেদের বই ‘রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী’ থেকে বিষয়টি জানা যায়।

মি. আহমেদ লিখেছেন, “১৯৭৮ সনে দেশে ফেরার পর থেকে অধ্যাপক গোলাম আযম বারবার আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। তার নাগরিকত্ব ছিলো না বিধায় রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা পালন করতেন ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান।”

সে ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-৯৪ সালের জন্য জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন গোলাম আযম।

জামায়াতে ইসলামী তখন গোলাম আযমের নাম প্রকাশ্যে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

নাজির আহমেদ লিখেছেন, “এই নির্বাচনে অধ্যাপক গোলাম আযম আমীরে জামায়াতে নির্বাচিত হলে তাঁর নাম প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হবে কিনা বিষয়টি কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও শেষে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায় আলোচিত হয়। আলোচনান্তে সিদ্ধান্ত হয় যে এবার প্রকাশ্যে নাম ঘোষণা করা হবে।”

গোলাম আযমকে জামায়াতের প্রকাশ্য আমীর ঘোষণা করা হয়, তখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বড় ধরণের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

যেভাবে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম গণ-আদালত

আন্দোলনের মুখে নাগরিকত্বের প্রশ্নে গোলাম আযমকে জেলে যেতে হয়েছিল।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর উনিশশো একানব্বই সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বেশি আসন পেলেও সরকার গঠনের জন্য অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন ছিল, আর সমর্থনের বিনিময়ে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এক অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়।
মতিউর রহমান নিজামী
ছবির ক্যাপশান, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার করা হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতাদের মধ্যে দলটির একজন আমীর মতিউর রহমান নিজামীও ছিলেন।

কয়েক বছর আগে গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহ-হিল আমান আযমী বিবিবি বাংলাকে বলেছিলেন, “এই সমঝোতা বা অনুকূল পরিবেশের সুযোগ নিয়েই জামায়াত গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয়ে বিরানব্বই সালের মার্চ মাসে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছিল। সেই গ্রেফতারের ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিক হয়ে দেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল”।

মি. আযমী আরও বলেছিলেন, নাগরিকত্বের প্রশ্নে হাইকোর্টে জামায়াত রিট মামলা করে এর পক্ষে রায় পেয়েছিল।

কিন্তু তখন সরকার হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গিয়েছিল।

গোলাম আযমের ছেলে আটক – জামায়াতের অভিযোগ

সুপ্রিমকোর্টে আপিল বিভাগ থেকে নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে ১৬ মাস জেল খাটার পর গোলাম আযম বেরিয়ে এসেছিলেন।
দুই হাজার আট সালের পরের জামায়াত

দুই হাজার আট সালের একেবারে শেষদিকে বাংলাদেশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

এরপর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়।

সে বিচারে গোলাম আযমসহ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই দণ্ডিত হয়।

গোলাম আযম দোষী, ৯০ বছরের কারাদণ্ড

যুদ্ধাপরাধের বিচার: প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে?

বয়সের কথা বিবেচনা করে গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিলে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।

এছাড়া দলটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড হয়।

সূত্র বিবিসি নিউজ বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *