Friday, March 29বাংলারবার্তা২১-banglarbarta21
Shadow

যুগে যুগে মানবঘাতী রোগ ও মহামারীর ইতিহাস

অনলাইন বার্তা: আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগে দাঁড়িয়েও মানুষ আজ বড় অসহায়। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ছোবলে সারা পৃথিবীর মানুষ আজ পর্যুদস্ত। এই ভাইরাসের কবল থেকে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কালো-সাদা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। বিশ্বের প্রায় দুই কোটি মানুষ আজ এই মানবঘাতী রোগে আক্রান্ত। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতিদিনই কয়েক হাজার আক্রান্ত মানুষ এই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা কেউই বলতে পারছে না এর শেষ কোথায়! কেউই জানে না কবে এই ধরিত্রী মহামারিমুক্ত হবে!
আরো পড়ুন: রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের কভিড-১৯ এর বিশেষ দুর্বলতা খুজে পাওয়ার দাবী

এ রোগের প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য বিশ্ববিখ্যাত গবেষকরা রাতদিন গবেষণা করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, উপযুক্ত প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত এ রোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উপায় নেই। যথোপযুক্ত প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত এই মরণব্যাধি ভাইরাসের সঙ্গেই হয়তো চলতে হবে। আর প্রতিষেধক বের না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর এই মহামারি হয়তো থামবে না। ইতিহাসও এমনটিই বলছে।
আরো পড়ুন: চট্রগ্রামে এখন আধুনিক চিকিৎসায় ব্যাংকক হাসপাতাল

প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, প্রস্তর যুগে খ্রিষ্টপূর্ব ৮৭০০-২০০০ সময়কালে অর্থাৎ, এখন থেকে ৫০০০ বছর আগে ‘প্লেগ ব্যাকটেরিয়া’ সংক্রমিত হয়ে ওই সময়ে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রস্তর যুগে ওই সময়ের মানুষের দাঁতের ‘ডিএনএ’ পরীক্ষা ও বিশ্নেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই তথ্য পান।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘অ্যাটোনিন প্লেগ’ মহামারিতে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মারা যায়। এরপর ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মানবসমাজে ‘প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান’ নামের ক্ষুদ্র সংক্রামক জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদদের মতে, ভয়ংকর এই মহামারিতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যতটুকু জানা যায়, একপর্যায়ে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। যারা বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে এই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। ১৮৯০-এর দশকে প্লেগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হওয়ার ফলে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের অণুজীব বিজ্ঞানী মারিয়া স্পাইরো মনে করেন, মহামারির বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের অভাব রয়েছে। তবে ‘ডিএনএ’ সেই অভাবকে ব্যাপকভাবে পূরণ করতে পারে। ‘ডিএনএ’-এর মাধ্যমে মহামারির প্রকৃত সময়কাল নির্ণয় করা যেতে পারে।

আরো পড়ুন: জেনে নিন বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নাম, পদবী ও ফোন নম্বর

১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবোনিক’-এ ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ওই সময়ে বিশ্বে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী এই বুবোনিক প্লেগ। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এই রোগের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রাদুর্ভাব এশিয়াতে শুরু হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ইউরোপ ও চীনে বিস্তার লাভ করে। মূলত কালো ইঁদুর ও মাছি থেকে ছড়িয়েছিল এই রোগ।

১৪২০ সালে রোমে ছড়িয়ে পড়ে ‘দ্য এপিডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ’ অর্থাৎ, দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়। কয়েক মাসের মধ্যেই এটি নিশ্চিহ্ন করে দেয় জনপদের পর জনপদ। পরবর্তীতে এটি অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, এ সময় বিশ্বে মোট জনসংখ্যা ৪৫ কোটি থেকে ৩৭ কোটি ৫০ লাখে নেমে এসেছিল।

ঠিক ১০০ বছর পরে ১৫২০ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের স্প্যানিশ বণিকরা নিয়ে আসে গুটি বসন্ত বা স্মল পক্স। ৯০ ভাগ আদিবাসী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। প্রায় এক লাখ মানুষ মারা যায়। একই সময়ে মেক্সিকোসহ সারা বিশ্বব্যাপী গুটি বসন্ত, হাম ও প্লেগ মহামারি রূপে দেখা দেয়।

আবারও ঠিক ১০০ বছর পর ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে আরেক মহামারি দেখা দেয়, যার নাম ‘মে ফ্লাওয়ার’। ওই সময়ের অজানা রোগ স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাসসহ ভাইরাস জ্বরে লন্ডন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। এর ঠিক ১০ বছর পর ১৬২৯ থেকে ১৬৩১ সালে ইতালিতে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আড়াই লাখ মানুষ মারা যায় এই মহামারিতে।

১৬৬৫ সালে গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন অস্ট্রেলিয়ার কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এর পাশাপাশি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সৈনিকদের মাধ্যমে আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় দেড়শ’ বছরের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কলেরায় মারা যায়।

১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই মানবজাতির ওপর হামলে পড়ে। শুধু ফ্রান্সেই মারা যায় ১০ লাখ মানুষ। ইতিহাসের তথ্যমতে, ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে সারা পৃথিবীজুড়ে ২০ কোটি মানুষ শুধু প্লেগ রোগে মারা যায়। এটি ছিল বিশেষ এক প্রকার বিউবোনিক প্লেগ। একই সময়ে রাশিয়া ও পার্সিয়া ভয়ংকর মহামারির কবলে পড়ে। দুই লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্ব সে সময় কলেরা প্রতিরোধের জন্য কোনো প্রতিষেধক পায়নি।

১৮২০ সালে ভারতবর্ষে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। কলেরায় লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। পরবর্তীতে এই কলেরা বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই শতকেই যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ইয়েলো ফিভার মহামারিতে ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়। এই রোগে উচ্চ তাপমাত্রাসহ সারা দেহে প্রচণ্ড যন্ত্রণার সৃষ্টি হতো। যার কারণে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ভয়াবহ মৃত্যু ঘটত। এক প্রকার মশা ছিল এ রোগের জীবাণু পরিবাহী। ১৯২০ সাসে আসে ‘দ্য স্প্যানিশ ফ্ল'”। এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ সৃষ্টি হয় এই প্রাণঘাতী জ্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে রোগটি দ্রুত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৫০ কোটির মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। আর সারাবিশ্বে ১০ কোটিরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই ভাইরাসে।

এবার ২০২০ সালে আবির্ভাব হয় করোনাভাইরাসের যা কভিড-১৯ নামে পরিচিত। ইতিহাসে একই সঙ্গে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে মানবঘাতী ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম। চীনের উহান থেকে উৎপত্তি এই করোনাভাইরাস আজ সারাবিশ্বে ২১৬টিরও বেশি দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে।

অতীতে মহামারি থেকে বাঁচার জন্য টিকা বা ভ্যাকসিনের আবিস্কার সহজ ছিল না। এজন্য মানবজাতিকে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৪০০ শতকে ভয়ংকর মহামারি ব্ল্যাক ডেথের সময় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন থাকার নিয়ম চালু হয়েছিল।

অনেক বিজ্ঞানী অক্লান্ত পরিশ্রম করে মহামারির টিকা বা প্রতিষেধক আবিস্কার করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এমন একজন বিজ্ঞানী ওয়াল্ডিমার হাভকিন। জন্মসূত্রে তিনি রাশান ইহুদি। অনেক গবেষণা কার্যক্রমের পরে তিনি ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হলেন। মানুষের দেহে এর কার্যকারিতা দেখতে গিয়ে অন্যের শরীরে প্রয়োগের ঝুঁকি না নিয়ে নিজের শরীরেই প্রয়োগ করলেন। বিস্ময়কর ফলাফল দেখলেন। এবার অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল দেখলেন। ১৮৯০ সালে পৃথিবী পেয়ে গেল অনেক আকাঙ্ক্ষিত কলেরার ভ্যাকসিন। লাখো কোটি মানুষ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসলেন। পরবর্তীতে হাভকিন প্লেগেরও প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এমনিভাবে ১৭৯৬ সালে গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কার করলেন এডওয়ার্ড জেনার।

করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা এর প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারা ক্যাথরিন গিলবার্ট করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কারে আশা জাগানোর মতো ফলাফল পাচ্ছেন বলে শুনছি। কার্যকর ভ্যাকসিন আবিস্কারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জগদ্বিখ্যাত গবেষকরা রাতদিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সারা পৃথিবীর শতকোটি মানুষ তাকিয়ে আছে একটি দিনের জন্য, যেদিন তারা জানতে পারবে করোনাভাইরাসের কার্যকর প্রতিষেধক আবিস্কারের কথা। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নেই।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী।
সংগ্রহে: সমকাল অনলাইন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *